ফুরফুরে হাওয়াই খুশির রেশ নিয়ে অনিফিশ ঘুমিয়ে
পরেছিল পাপাঙ্গুলের হোগলা পাতার ছাউনি দেওয়া ঘরে। ভোরের একটা মিষ্টি নরম আলো এসে
পরেছে সেই অনিফিশের সোনালি পাখনার ওপর। চারিদিকে একটা নতুনের গন্ধ। নতুন দিন। নতুন
বছর।। কাল পাপাঙ্গুলের দেশের লোকেরা সারা রাত ধরে অনেক আনন্দ উৎসব করে অনিফিশকে
নিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছে। এটাই
পাপাঙ্গুলের দেশের নিয়ম। এরা ছেলে-বুড়ো কচি-কাঁচা সব্বাই একসাথে সেই দুরের টিলার
কাছে যায় নতুন বছরকে স্বাগাত জানাতে। যে যেমনটি পারে নাচ-গান করে একসাথে মজা করে সারা
রাত ধরে। পরদিন সক্কাল বেলা সবাই নতুন সবুজ হোগলা পাতায় তাদের ঘর ছাউয়ায়, উঠনে নানান
রঙের ছবি আঁকে। সবাই নতুন পালক দিয়ে সাজে, আর আনেক খাওয়া দাওয়া, আনন্দ করে।
অনিফিশ তার সোনালি পাখনায় একটা ছোট্ট আড়মোড়া
ভেঙ্গে তাকাল পাপাঙ্গুলের দিকে। সে দেখে পাপাঙ্গুল তার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে।
হাতে তার একটা সবুজ রঙের খাতা। সেটাই পাপাঙ্গুল খুব সুন্দর একটা ফিতে দিয়ে বেঁধে
রাখছে। অনিফিশ একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে পাপাঙ্গুলের পাশে এসে খাতাটার দিকে তাকিয়ে বড়
বড় চোখ করে বলে “পাপাঙ্গুল এটা কি?”
পাপাঙ্গুল বলে, “সুপ্রভাত অনিফিশ। কাল তোমার
ঘুমোতে আনেক দেরি হয়ে গেছিল তাই আর তারাতারি তোমাকে ডাকিনি। কাল ঘুম কেমন হল,
পাপাঙ্গুলের এই ছোট্ট হোগলা পাতার ঘরে?
অনিফিশ লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল “যাহ্ কি যে
বল তুমি পাপাঙ্গুল , আমি তো আনেক দিন বাদে এমন সুন্দর একটা রাত কাটালাম কাল
রাত্রে। আমি যে কি খুশি হয়েছি তোমার দেশে এসে কি বলবো। এমন সুন্দর নির্ভেজাল
ভালবাসার দেশ আমি আগে কখন দেখিনি।”
পাপাঙ্গুল হেসে বলল “দেখবে দেখবে। দেখার কি আর শেষ আছে বন্ধু? কত দেশ, কত মানুষ, কত
অজানা জিনিস, এসব দেখব বলেই তো ছাঁকনি চরে দেশ ছেড়ে দেশে বিদেশে ঘোরা। ঘরে থাকতে আমার একটুও ভাললাগে না অনিফিশ...জীবনটা কত ছোটো বলো। এইটুকু জীবনে কত কি দেখার জানার আছে বাকি।”
পাপাঙ্গুলে দেখে অনিফিশ তার ছোট পাখনাটা দিয়ে
পাপাঙ্গুলের সবুজ খাতায় নরম করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। পাপাঙ্গুল বলল –“অনিফিশ তুমি
জিজ্ঞেস করছিলে না এটা কি?...এইটা আমার দিনলিপির খাতা। যখন যেখানে যা দেখি, আমার ভাললাগা খারাপ লাগার
কথা, আমার বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা, আমি এই খাতায় লিখে রাখি রোজ। অবশ্য সত্যি বলতে রোজ
লিখতে পারিনা। তবে যখন যেমন সময় পাই আমি এই খাতা খুলে বসি। বলতে পার এটা
পাপাঙ্গুলের বন্ধু - তোমারই মতো। খুব কাছের বন্ধু।”
অনিফিশ ত কোন দিন দিনলিপির কথা শোনেনি, তাই
সে ভারি খুশি হোল পাপাঙ্গুলের কথা শুনে। সে ভাবল সত্যি তো, এ তো ভারী ভাল জিনিস। এভাবে যদি কেউ সব কথা লিখে রাখে দিনলিপিতে তাহলে মাঝে-মধ্যে
গল্পের মত এই খাতা পরে খুব ভাল লাগবে। এই ভেবে সে আনন্দে একটা ছোট্ট ডিগবাজি খেয়ে
নিল । অনিফিশ তা এমনি অল্পে খুশি, অল্পে দুখী, মনের মাঝে কিছু ছেপে রাখতে পারে না।
শরীর টার মত মনটাও সোনালি আর নরম। অনিফিশ পাপাঙ্গুলকে বলল, “আচ্ছা অনিফিশ আমি এবার
একটু সাঁতার কেটে আসি।” তোমাদের তো আগেই
বলেছি সাঁতার কাটা অনিফিশের শখ। তা ছারা অনিফিশ তো জলের দেশের প্রাণী, তাই জল
ছাড়া সে বেশীক্ষণ থাকতে পারে না, মন খারাপ করে।
তাই সে সাগরপারে চলে গেল একটু সাঁতার কাটতে।
পাপাঙ্গুলের ঘর থেকে সমুদ্র বেশি দূরে নয়, তাই তার পথ চিনতে কোন অসুবিধা হলনা।
এদিকে পাপাঙ্গুল ঘোরের বশে ভাবছিল অনিফিশকে কি দাওয়াত খাউয়াবে। অনিফিশ তার দেশের
অতিথি বলে কথা। কাল তো না হয় ডাকপুলি খেয়ে সবারই পেট ভর্তি ছিল। যেই না এসব ভাবতে ভাবতে সে
ঘর থেকে বেরিয়েছে, দেখে কয়েক জন পাপাঙ্গুল দিদি এসেছে। সাথে চটপটি দাদু। চটপটি দাদু তো পাপাঙ্গুলের দেশের সবচেয়ে বড়। দাদুকে পাপাঙ্গুলের দেশের সবাই খুব ভালবাসে আর মানে। তাই তারা সব কাজে দাদুর অনুমতি নেয়। তো সেই চটপটি দাদু বলল – “পাপাঙ্গুল
আজ আমার বাড়িতে তোমার আর অনিফিশের দাওয়াত। আজ আমরা সবাই মিলে একসাথে খাব। তোমাকে তাই সকাল সকাল বলতে এলাম। এই কথা তা শুনে পাপাঙ্গুলের মন
তো খুশিতে ভরে উঠল। চোখের কোণে এক চিলতে জল। পাপাঙ্গুল বুঝে পেল না দাদু কে কি
বলবে। মাঝে মাঝে এমনও হয় যখন সব কথা গলার কাছে এসে আটকে যায়, খুশির আবেগে। কি একজন
আর একজনের না বলা কথা বুঝে যায়, ভালবাসায় সবাই বুঝি এভাবেই একে অন্যকে কাছে টেনে
নেয়। নাহলে কত বছর সে দেশছাড়া, সে কি ভেবেছিল এতো বছর পর দেশে ফিরে তাকে সবাই এমনি
করে আপন করে নেবে? এভাবে আবার আদর-ভালবাসায় ভরিয়ে দেবে! পাপাঙ্গুল মুখে কিছু বলতে
পারল না খালি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
অনিফিশ সমুদ্রের নিল জল দেখে খুশীতে নেচে
উঠল। পারের থেকে তাই লম্বা একটা লাফ দিয়ে পরল অনেক দূরের নিল জলে। আঃ! কি আরাম!
অনিফিশ তার পাখনাটা এদিক-ওদিক করে অনেকক্ষণ সাঁতার কাটল জলে। কিছুক্ষণ পড়ে বাইরে
আওয়াজ শুনে মাথা তুলতে দেখে একদঙ্গল বাচ্ছা পাপাঙ্গুলের ছানা হুল্লোর করতে করতে আসছে
সমুদ্রের দিকে। কালকে এই ছোট্ট ছানাগুলোই তো ওকে ঘিরে নাচ করছিল। অনিফিশ সাঁতরে পারে এসে ডাক দিল তাদের। অনিফিশকে দেখে
তারা তো হই-হই করতে করতে এলো অনিফিশের কাছে। অনিফিশ বলল - “তোমরাও বুঝি সাঁতার কাটতে এসেছ?”
ওদের মধ্যে একজন বলল আমরা তো প্রায়ই আসি সমুদ্রে। তবে, আজ এসেছি
আনন্দ-স্নান করতে। মানে নতুন বছরের প্রথম দিনে আমরা সবাই এক সাথে সমুদ্রে স্নান
করে নতুন জামা পড়ে বড়দের নমস্কার করে আসি। তারপর আজ তো ভীষণ মজা। তুমি জান না? আজ
দুপুরে আমাদের সবার চটপটি দাদুর বাড়িতে দাওয়াত। তুমিও তো যাবে সেখানে। এই শুনে
অনিফিস বেজায় খুশি হয়ে চোখ বড় করে বলল - “সত্যি?” তখন সবাই মিলে বলে উঠল - “সত্যি...সত্যি...সত্যি।
আহা আলঙ্গুশ...আহা আলঙ্গুশ...আজকে মোদের মেজাজ বড় খুশ।””